সংসার একটি বাগান, তার মহাশক্তি মা

সচিত্র সিলেট
প্রকাশিত আগস্ট ২৫, ২০২৫
সংসার একটি বাগান, তার মহাশক্তি মা

এমএ রহিম:

‘সংসার একটি বাগান। মা হলেন ওই বাগানের মহাশক্তি। তিনি সংসার নামক বাগানকে সাজিয়ে তোলেন। বাগানটি কেমন হবে, তা নির্ভর করে মায়ের রুচি আর সাধনার ওপর। আমি বাংলাদেশে সংসার নামক ওই বাগান দেখেছি অনেক। অনেক সংসার থেকে ওলি, আউলিয়ার আগমন ঘটেছে। মায়ের বিনয়ী দোয়া আর যতেœর কারণে এমনটি হয়েছে-তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ পরিচালনার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত-তাঁরা কোনো না কোনো মায়ের সন্তান। মহান রবের দরবার দুই হাত তুলে চোখের পানি ফেলেছেন। যার জন্যে ওই মায়ের সন্তান দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত। গর্ভধারিনী মা কোনোদিনই চাননা, তার সন্তান অপরাধী হোক। তারপরও হয়ে যায়। ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমার মা। যার দোয়া, আদর, সোহাগ আর যতেœ গড়ে উঠেছে আমাদের সংসার। প্রতিদিনই শতশত মানুষ আমার কাছে আসেন চিকিৎসা সেবা নিতে। তাঁদেরকে শুধু চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় না, সাথে আপ্যায়নও করা হয়। সবই আমার গর্ভধারিনী মায়ের দুই চোখের পানির মূল্য। যার জন্যে আজ পর্য্যন্ত মায়ের অবাধ্য হয়নি। মায়ের মহাশক্তি দোয়ায় জীবনের সাধন সফল হয়েছে।’

সিলেট শহরতলির ইসলামপুরের জাহানপুরের আধ্যাত্মিক পুরুষ মো. মাসুক মিয়া ওইভাবে বর্ণনা দেন মায়ের দোয়ার মহাশক্তি সম্পর্কে।

তিনি বলেন, ‘সাড়ে চার বছর পর বাড়ি ফিরে সাড়ে ১১ বছর বয়সে রাজমিস্ত্রির সহযোগি হিসেবে কাজ শুরু করি। পর্যায়ক্রমে মাটির কাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছি। সর্বশেষ অটোরিকশার চালক হিসেবে কাজ করেছি। ২০০৯ সালের কথা। প্রথমবারের মত স্ট্রোক করার পর সুস্থ হয়ে উঠেন মা। একদিন পাশর্^বর্তী এলাকার পরিচিত একটি বাড়িতে যান। ওই পরিবারটির বাড়ি দোয়ারাবাজারে। ওই পরিবারের একটি মেয়ে কাজের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের চোখে পড়ে। বাড়ির কর্তাকে মা জানালেন মেয়েটিকে ঘরের বউ হিসেবে নিতে চান। এই প্রস্তাবে বাড়ির কর্তা খাতির যতœ শুরু করেন মাকে। সহজ সরল মাকে সময়ের সুযোগ না দিয়ে বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেন। বিয়ে পাকা করতে পাশর্^বর্তী বাড়ির ক্রিমিনাল প্রকৃতির দুইজনকে ডেকে আনে বাড়ির কর্তা। মা বাসায় ফিরে আমার বিয়ের কথা জানান। এও জানান পাকাপাকি করে ফেলেছেন বিয়ে। মায়ের কথায় অবাধ্য হয়নি। এমনকি কন্যা দেখারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। বিয়ের বাজার করি ঋণ করে। বিয়ের বাজার বাসায় রেখে মাকে নিয়ে পাশেই অবস্থিত খালার বাসায় গিয়েছিলাম। ফিরে দেখি বিয়ের বাজার চোর নিয়ে গেছে। একটা ধাক্কা খেলাম। কিন্তু মায়ের পছন্দের কন্যাকে যথা সময়ে বিয়ে করে বাসায় তুলি। ২-৩ দিন যেতই নববধূর রূপ প্রকাশ পায়। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাকে অপমান করতে থাকে। এভাবে বছরখানিক কেটে যায়। ভাবলাম, সন্তান নিলে হয়তো বদমেজাজ কেটে যাবে আমার বধূর। সন্তান নিলাম। আমাদের সংসার আলো করে সন্তান জন্ম নেয়ার ৪০ দিনের মাথায় আমার মা তাঁর পিত্রালয়ে (আমার নানার বাড়ি) যান। ৩-৪ দিনের মাথায় লন্ডন প্রবাসী এক ভদ্রলোক আমার অটোরিকশা রিজার্ভ করে আমাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যান। যাওয়ার সময় ঘরে পর্যাপ্ত খাবার ও খালাকে রেখে যাই। তিনদিন পর বাড়িতে ফিরে আসি। বাড়িতে ফিরে দুর্ব্যবহারের শিকার হই স্ত্রীর কাছে। একটু প্রতিবাদ করায় দেড় মাসের শিশু সন্তানকে রেখে আমার স্ত্রী ঘর থেকে বের হয়ে যান। পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যায়। দেড় মাসের শিশুকে খাওয়ানো নিয়ে মহাবিপাকে পড়তে হয়। একটা সময়ে এক নারী এগিয়ে আসেন। আমার শিশু সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। এই খবর পেয়ে নানার বাড়ি থেকে ফিরে আসেন মা। আমার স্ত্রীর সন্ধানে দৌড়ঝাপ শুরু করেন মা। ১০ দিন পর তার সন্ধান মেলে তার পিতার ঘরে। মা তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন। আমার মাথায় হাত রেখে সান্ত থাকতে বলেন মা। কয়েকদিন পর আমি নগরীর জিন্দাবাজারে অবস্থান করছিলাম অটোরিকশা নিয়ে। এমন সময় খবর পাই মায়ের অবস্থা খারাপ। পাগলের ন্যায় বাসায় ফিরে আসি। বাসায় ফিরে দেখি মায়ের হাত থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে। নিজকে সামলে মাকে নিয়ে গেলাম স্থানীয় ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার সাহেব ড্রেসিং করে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনোভাবেই রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। প্রায় ঘন্টাখানিক পর রক্ত বন্ধ হয়। মায়ের মুখ থেকে জানতে পারি তিনি আমার স্ত্রীকে শাসন করার জন্যে ধমক দিয়েছিলেন। যার জের ধরে আমার স্ত্রী আমার মাকে বেদম মারপিট করে। কামড় দিয়ে হাতের মাংস তুলে নিয়েছে। সমস্ত শরীরে দাগ পড়েছিল মায়ের। বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার জন্যে স্ত্রীর শরীর পরীক্ষা করি। কিন্তু একটি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি স্ত্রীর গায়ে। ইতোমধ্যে কতিপয় সালিশ ব্যক্তি আমার বাসায় গিয়ে হাজির হয়। তারা বৈঠকে বসে আমার মাকে দোষারপ করার চেষ্টা করেন। আমি তাদেরকে পুরো বিষয়টি বুঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু মঞ্জু নামে এক সালিশান একতরফা কথা বলে যাচ্ছিলেন। মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। তখন মঞ্জুকে বলেছিলাম তোমার মত ১০ মঞ্জু খেয়ে ফেলার শক্তি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। এই কথা বলতেই মঞ্জু আমার ঘর থেকে বের হয়ে যান। সাথে আমার স্ত্রীও। সাথে করে নিয়ে যান আমার আয় থেকে জমানো প্রায় ৭০ হাজার টাকা। ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র কাপড় চোপর। প্রায় ২ মাস বয়সের আমাদের শিশুকেও নিয়ে যায়। এক বছর পর আমার শিশু বাচ্চাকে ফিরিয়ে দেয়। তখন আমার বাচ্চাটি প্রায় মৃত পথযাত্রী। সিলেট ও ঢাকার অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু কোনো ফল আসছে না। একদিন হযরত শাহপরাণ (রহ.) এর মাজার মসজিদে ছুটে যাই। সেজদায় পড়ে মহান রবের কাছে আমার সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চাই। সেজদা থেকে উঠে আমার প্রিয় একজনের সাথে দেখা করি। তিনি একটি গাছের পাতার নাম বলে দেন। ওই পাতা আমার বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্যে বলেন। পাতা নিয়ে বাসায় ফিরি। পাতাটি খাওয়ানোর পর আমার শিশু সন্তান মল ত্যাগ করতে থাকেন। মলের সাথে নানান ধরণের আবর্জনা বের হয়ে আসে। এক সময় পেট খালি হয় আমার শিশু সন্তানের। ২-৩ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেন। সাথে ছিল মায়ের দোয়ার শক্তি।’

আধ্যাত্মিক পুরুষ মাসুক মিয়া জানান, ‘মায়ের সেবার মধ্য দিয়ে সময় কেটে যাচ্ছিল। ২০১২ সালের প্রথম দিকের কথা। একজন ঘটক বললেন তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘটকের কথায় রাজি হয়ে বললাম চলেন কনে দেখে আসি। যেই কথা সেই কাজ। কনে দেখতে গেলাম। কনের সাথে কথা বললাম। আমি কনেকে জানালাম, আমার মা পাগল। তাঁর সেবা করতে হবে। পারবে কিনা? কনে এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। বাড়ি ফিরে মাকে জানালাম। ২০১২ সালের ৫ ফেব্রæয়ারি টাইটেল পাস নাজমা আক্তারের সাথে বিয়ে হয়। আমার স্ত্রী নববধূ হিসেবে আমার বাসায় আসেন। মা বরণ করে নেন তাকে। কিন্তু আমার মাকে সুস্থ দেখে অবাক হয়ে পড়েন নববধূ। সেই থেকে আমার মায়ের সকল দায়িত্ব বহন করে চলেছেন নাজমা। আমার পীর মা আমাদের জন্যে তাঁর মহাশক্তির দোয়া করেন রাতদিন।

September 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930