এমএ রহিম:
‘রমজান মাসের কয়েকদিন না যেতেই মায়ের শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে। ৮ কি ৯ রমজানে সিলেটের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করি মাকে। মায়ের বয়স ৯০ বছর। সকল পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার জানিয়ে দিলেন কোনো জটিলতা নেই। এও জানালেন ২-১ দিনের মধ্যে ছাড়পত্র দিয়ে দেবেন। আমার মন থেকে অস্থিরতা কেটে যায়। বিশেষ করে বিশে^র বিভিন্ন দেশে ও দেশে বসবাসরত ভাই বোনসহ আত্মীয়স্বজনের মধ্যে স্বস্তি দেখা দেয়। রমজান মাস হওয়ায় পালাক্রমে মায়ের শয্যাপাশে আমি, আমার স্ত্রী ও সন্তানরা অবস্থান নিতে থাকি। ১৬ মাচর্-২০২৫ অর্থাৎ ১৫ রমজান আমি সিলেট নগরীর উপকন্ঠ ইসলামপুরের মোহাম্মদপুরের বাসায় অবস্থান করছিলাম। হাসপাতালে মায়ের শয্যাপাশে ছিলেন আমার সন্তানেরা। সন্ধ্যায় ইফতার শেষে নামাজ আদায় করি। পরে তারাবির নামাজ আদায় করি। শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ি। সেহরি খাওয়ার কয়েক মিনিটের মাথায় ফজর নামাজের আজান পড়ে। বাসার পাশে অবস্থিত মসজিদে গিয়ে ফজর নামাজ আদায় করি। বাসায় ফিরে পোশাক পাল্টে রওয়ানা হই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। কোনো যানবাহন নেই। টিলাগর পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে একটি অটোরিকশা পাই। ওই গাড়িতে তিনজন যাত্রী ছিলেন। আল্লাহ’র উপর ভরসা করে ওই অটোরিকশায় চেপে বসি। এর মধ্যে মোবাইলে ভিডিও কল আসে। ওই ভিডিও কলে আমার আত্মীয়স্বজনরা সংযুক্ত হয়ে কান্নাকাটি করছিলেন। মানসিকভাবে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। ভোর ৬ টার আগেই হাসপাতালে পৌঁছি। হাসপাতালের ১০ তলার একটি কেবিনে মা চিকিৎসাধীন ছিলেন। লিফটের অপেক্ষা না করেই সিঁড়ি বেয়ে ১০ তলায় উঠি। শয্যাপাশে গিয়ে দেখি মায়ের অবস্থা ভালো নয়। প্রচন্ড শ^াসকষ্ট। ওই সময় মাকে দেখার জন্যে হাসপাতালে কোনো ডাক্তার ছিল না। রমজান মাস। কি করি, ভেবে পাচ্ছিলাম না। সাহস করে ৩-৪ জন ডাক্তারকে ফোন দেই। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ৩ জন ডাক্তার এসে হাজির হলেন। তাঁরা পর্যবেক্ষণ করলেন মায়ের। তিনজন একমত হয়ে জানালেন আইসিইউতে ভর্তি করতে হবে মাকে। রাজি হয়ে গেলাম। আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার পূর্ব মূহূর্তে মা আমার দেহে হাত বুলিয়ে দেন। এক সময় তিনি উপরের দিকে হাত তুলে বললেন আল্লাহর হাওলা করে দিলাম। এর পরপরই তিনি জ্ঞান হারান। আইসিইউতে নেয়া হলো মাকে। সেখানে আমাদের প্রবেশাধীকার সংরক্ষিত করা হলো। এই দিনটি ছিল ১৬ রমজান অর্থাৎ ১৭ মার্চ। সারাটি দিন আমাদের কেটে যায় অস্থিরতার মধ্যে। ডাক্তাররা জানিয়ে দিলেন অবস্থা ভালো নয়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার অবস্থা আমার। অনুমোতি পেয়ে মাঝে মধ্যে আইসিইউতে গিয়ে দেখে আসতাম মাকে। রাত ১০ টার একটু আগে আবার প্রবেশের অনুমোতি পেলাম। শয্যাপাশে অবস্থানের সময় রাত ঠিক ১০ টা ২০ মিনিটে ডাক্তার জানিয়ে দিলেন মা আমাদের মাঝে নেই। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। আমাদের জন্যে দোয়া করার প্রিয় মা চলে গেলেন। যে মায়ের দোয়া সাথে নিয়ে সারাটি জীবন নিরাপদে কাটিয়েছি। আজ হারিয়ে ফেললাম মায়ের দোয়ার শক্তি। সেই মা নেই-ভাবতেই দুই চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে।’ সিলেট জেলা বিএনপির অন্যতম সদস্য সৈয়দ এনায়েত হোসেন গর্ভধারীনি মা শেখ লায়লা বেগমের পরপারে যাওয়ার বিবরণ দেন ওইভাবে। বার্ধক্যজনিত রোগে মা প্রায় সময় অসুস্থ হয়ে পড়তেন। এ নিয়ে আমার স্ত্রী ও সন্তানরা অস্থির হয়ে পড়তেন। সেবা যতেœ সার্বক্ষণিক তারা মায়ের পাশে অবস্থান করতেন।’
সৈয়দ এনায়েত বলেন, ‘আমরা ৪ ভাই ও তিন বোন। এর মধ্যে তিন ভাই বসবাস করেন প্রবাসে। তিন বোন স্বামী সংসারে। পিতা সৈয়দ আবদুন নূর উরফে নূর মিয়া ২০০০ সালের ৭ জুন ইন্তেকাল করেন। আমাদের গ্রামের বাড়ি সিলেট জেলার ওসমানীনগর থানার উছমানপুর গ্রামে। এখানেই শৈশব, কৈশোর কেটেছে আমাদের। উচ্চ শিক্ষার জন্যে পরবর্তী সময়ে আমরা সিলেট নগরীতে বসবাস করতে থাকি। ৭ ভাই বোনের মধ্যে আমি ৫ম। বড় ভাই নিজাম উদ্দিন জাহাঙ্গির একজন ব্যবসায়ী, বোন সৈয়দা আবেদা বেগম স্বামী সংসারে, সৈয়দা সাফিয়া খানম স্বামী-সন্তান নিয়ে আমেরিকায়, ভাই সৈয়দ বেলায়েত হোসেন যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন, ছোট ভাই সৈয়দ শাহাদাত হোসেন বসবাস করেন আমেরিকায় এবং ছোট বোন রাজিয়া আক্তার স্বামী-সন্তান নিয়ে ফ্রান্স প্রবাসী। স্ত্রী নিলুফার হোসেন ও আমাদের সংসারের তিন জান্নাত নিশাত তাসনিম, নিশাত আঞ্জুম ও নিশাত আনানকে নিয়ে আমার সুখি পরিবার।’
তিনি বলেন, ‘গর্ভধারিনী মা ছিলেন আমাদের শিক্ষা জীবনের প্রথম শিক্ষক। যতœসহকারে তিনি প্রথমে আমাদেরকে আরবি শিক্ষা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বাংলা শিখিয়েছেন। লেখাপড়ার বিষয়ে কড়া নজর থাকতো মায়ের। লেখাপড়ার বিষয়ে কোনো আপস করেননি। মা নিজে যতœ করে নামাজ পড়া শিখিয়েছেন। নামাজ ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। সাতসকালে ঘুম থেকে উঠতেন। আগে নিজে নামাজ পড়তেন। অনেকদিন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে তসবিহ নিয়ে বসতেন। ফজরের আজান দেয়ার পর ফজর নামাজ পড়তেন। পরে আমাদের সবাইকে ডেকে তুলতেন। যাদের বয়স নামাজ পড়ার জন্যে উপযোগি হয়েছিল, তাদেরকে নামাজ পড়তে তাড়া দিতেন। এর পরপরই প্রথমে আরবি পড়তে হতো। পরে বাংলা। স্কুলে যাওয়ার সময় হলে সবাইকে এক এক করে প্রস্তুত করে স্কুলে পাঠাতেন। স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত মা। সবাই স্কুল থেকে ফেরার পর দুপুরের খাবারের আয়োজন করতেন মা। আছর নামাজের পর খেলতে পাশের মাঠে ছুটে যেতাম। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই আমাদেরকে ফিরতে হতো। হাত মুখ ধুয়ে সন্ধ্যার পর পড়তে বসতাম। রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত লেখাপড়া করতে হতো। রাত ১০ টার মধ্যে খাবার শেষ করে ঘুমুতে যেতাম। সংসারের সকল কাজ সম্পন্ন করে গভীর রাতে ঘুমোতে যেতেন মা।’
সৈয়দ এনায়েত বলেন, ‘আমাদেরকে মানুষ করার জন্যে মায়ের সতর্ক নজর ছিল আমাদের উপর। নামাজ পড়ে দুই হাত তুলে আমাদের জন্যে দোয়া করেছেন। ফেলেছেন চোখের পানি। মায়ের ওই চোখের পানি অনেকদিন দেখতে হয়েছে। প্রবাসে যাওয়ার জন্যে তিন ভাইকে অনুমোতি দিয়েছেন। কিন্তু আমাকে সবসময় নজরবন্দি করে রেখেছেন। মায়ের কাছে রেখে দিয়েছেন আমাকে। মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে হয়েছে আমাকে। প্রথমে তিনি একাকী কনে দেখেছেন। পরে কনে দেখতে নিয়ে গেছেন আমাকে। কনে দেখার পর আমার কাছে জানতে চান পছন্দ হয়েছে কিনা। আমি মাকে জানিয়ে দেই ‘আপনি যাকে পছন্দ করবেন তাই আমার পছন্দ। এই কথা বলার পর মা কনের হাতে ধরিয়ে দেন সালামির টাকা।’
তিনি বলেন, ‘ মা আমাদেরকে নানান ধরণের উপদেশ দিতেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল মিথ্যা বলা যাবে না। কারো হক নষ্ট করা যাবে না। কারো হক খেয়ানত করা যাবে না। কারো সাথে দুষ্টুমি করা যাবে না। কেউ অন্যায় আচরণ করলে প্রতিবাদ না করে বাড়িতে এসে বলতে হবে। পরে অন্যায় আচরণকারীর ব্যাপারে তার মা বাবার কাছে নালিশ করা যাবে। এমন অনেক উপদেশ আমাদের জীবনে পাথেয় হিসেবে কাজ করছে।’
এনায়েত হোসেন বলেন, ‘রাজনীতির কারণে মা সব সময় অস্থির থাকতেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছর নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন অনেক। ১৯ টি মামলার পরোয়ানা নিয়ে সার্বক্ষণিক পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। প্রতিদিনই বিশেষ ব্যবস্থায় মায়ের সাথে যোগাযোগ করতাম। স্ত্রী-সন্তানের কাছ থেকে জানতে পেরেছি সারারাত জেগে মা মহান রবের দরবারে দোয়া করতেন। এভাবে অনেক রাত কেটেছে নির্ঘুমভাবে। স্কুলে পড়ার সময় আমাকে নিয়ে অস্থির থাকতেন মা। সব সময় মায়ের একটা কথা ছিল ঘর থেকে বের হওয়ার সময় যেন মাকে বলে ঘর থেকে বের হই। মায়ের ওই উপদেশ সবসময় মানতাম। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মাকে বলতাম। মা এগিয়ে এসে মাথায় হাত দিয়ে বলতেন আল্লাহর হাওলা।’
সৈয়দ এনায়েত বলেন, ‘মায়ের দোয়ার শক্তি অনেক। তার প্রমাণও পেয়েছি। ৭ম শ্রেণিতে অধ্যায়ন করার সময় একদিন বেতনের টাকা আমার হাতে তুলে দেন। আমি টাকা নিয়ে সিলেট শহরে চলে আসি। একটি ফুটবল ক্রয় করি। একটি গেঞ্জিও ক্রয় করি। এতে টাকা প্রায় শেষ হয়ে যায়। হাতে ছিল ২০০ টাকার মত। ওই টাকা নিয়ে ট্রেনে করে আমি ঢাকায় চলে যাই। সন্ধ্যার দিকে কমলাপুর রেলস্টেশনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের গ্রামের এক লোককে দেখতে পাই। তিনি কাছে এসে আমাকে ধরলেন। বললেন তুমি এখানে কিভাবে এলে ? বাড়িতে তোমার মা অস্থির হয়ে আছেন। তিনি আমাকে নিয়ে ট্রেনযোগে সিলেট ফেরেন। বাড়িতে পৌঁছে দেন আমাকে। বাড়িতে ফিরে দেখলাম মায়ের করুণ অবস্থা। পরে বাড়ির অন্য সদস্যদের কাছ থেকে জানতে পারি-আমাকে না পেয়ে মা সেজদায় চলে যান। সেজদায় গিয়ে অবিরাম চোখের পানি ফেলেছেন। বুঝতে পারলাম মায়ের দোয়া কবুল হয়েছে। কারণ কমলাপুর রেলস্টেশনে নামার পর আমার পুরো দেহটা যেন কেমন করছিল। আমার জান্নাতী মা নেই-যখন ভাবি তখন আমার চারদিকে যেন অন্ধকার নেমে আসে।’