এমএ রহিম:
‘বয়স তখন ৭ বছর। ১৯৯৯ সালের কথা। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাকিম একদিনের কথা বলে ঢাকায় গেছেন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে। ঘরে রেখে গেছেন একদিনের খাবার। কিন্তু তিনদিন কেটে গেছে। বাবা বাড়িতে ফিরে আসেননি। রেখে যাওয়া একদিনের খাবার খেতে হয়েছে তিনদিন। তারপর ফুরিয়ে যায় খাবার। গর্ভধারিনী মা এ নিয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে পড়েন। কারণ আমি সহ্য করতে পারতাম না খিদে। মাকে খাবার দিতে বলি। কিন্তু তিনি খাবার দেবেন কোথা থেকে। ঘরে কোনো খাবার নেই। মা অস্থির হয়ে উঠেন। আমার জন্যে এক মুঠো ভাত সংগ্রহ করতে আশপাশের তিনটি বাড়িতে পালাক্রমে ছুটে যান। কিন্তু ওই তিনটি বাড়ি থেকেই মাকে ফিরতে হয় খালি হাতে। সর্বশেষ চতুর্থ বাড়িতে গিয়ে মা আর খালি হাতে ফেরেননি। একজন মহিলা মায়ের হাতে তুলে দেন ভাত ও ডাল। ওই ডাল-ভাত নিয়ে বাড়িতে ছুটে আসেন মা। আমি কাহিল হয়ে বারান্দায় পড়েছিলাম। ডাল আর ভাত আমার সামনে রাখেন। ভাত দেখে ওই শিশু বয়সেই চোখে পানি চলে আসে। ওই অবস্থায় ভাত খাওয়া শুরু করি। ভাত খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ি। ওই সময় প্রতিজ্ঞা করি খিদেকে যেভাবেই হোক জয় করতে হবে। সাধন করতে হবে খিদেকে নিয়ে। সফল হয়েছি। এখন এক মাস পর্যন্ত না খেয়ে দিনযাপন করতে পারি। মনে আছে পরদিন ঘুম থেকে উঠে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছাড়ি। সিলেটের সীমানা পেরিয়ে চট্টগ্রামে চলে যাই। সেখান থেকে খাগড়াছড়ি জেলার তানজিল পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে চলে যাই। এই জঙ্গলেই কাটিয়ে দিয়েছি সাড়ে চার বছর। জীবজন্তু ছিল সঙ্গি। খাবার ছিল গাছের লতাপাতা আর পাহাড়ি ফল। খিদে নিবারণের সাধন চালিয়ে যেতে থাকি। এই গহীন জঙ্গলে কমপক্ষে ৫০ বার বিপদে পড়েছি। এর তিনটি বিপদ ছিল ভয়ঙ্কর। একবার বাঘ তাড়া করে। ভাল্লুকের তাড়া খেয়েও বেঁচে গেছি। বনমানুষের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো পথই ছিল। কিন্তু রক্ষা পেয়েছি অলৌকিকভাবে। এতসব বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে প্রতিবারই মনে হয়েছে মায়ের দোয়ায় রক্ষা পাচ্ছি। গভীর জঙ্গলে এভাবে কেটে যায় সাড়ে চার বছর। সাধন করেছি খিদে নিবারণ করার শক্তি। সেই সঙ্গে ভয়কে জয় করেছি। জঙ্গলবাসের অবসান ঘটিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা হই। যখন বাড়ি ছেড়েছিলাম, তখন জাহানপুর থেকে ইসলামপুর পর্যন্ত রাস্তাটি কাঁচা ছিল। কিন্তু সাড়ে চার বছর পর ফিরে দেখলাম রাস্তাটি পিচঢালা রাস্তায় পরিণত হয়েছে। ওই রাস্তা ধরে গন্তব্যে পৌঁছলাম। কিন্তু সব কিছুই অচেনা মনে হচ্ছিল। কেউ আমাকে চিনতেও পারছিল না। কারণ আমার বেশভুষা ছিল পাগলের ন্যায়। মাথায় ছিল লম্বা চুল। এক সময় আমি ২-১ জনকে চিনলাম। তাদেরকে পরিচয় দিলাম। এসময় জানতে পারি কিছুদিন আগে আমার বাবা মহান রবের ডাকে সারা দিয়ে পরপারে চলে গেছেন। মানুষিকভাবে আঘাত পেলাম। জাহানপুর কবরস্থানে গিয়ে বাবার কবরের পাশে দাড়ালাম। সেখানেই দাড়িয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম আর বাড়ি ফিরে যাব না। ইতোমধ্যে আমার আগমনের খবর পেয়ে গেছেন মা। ছোট দুই বোনকে সাথে নিয়ে রাস্তা ধরে দৌড়াতে থাকেন আমার উদ্দেশ্যে। আমাকে ঝাপটে ধরেন মা। ততক্ষণে সেখানে অনেক লোকজন জড়ো হয়ে যান। মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সেই কান্নার আওয়াজ গগনবিদারী। মা আর বোনেরা আমাকে ধরে নিয়ে যান বাসায়।’
‘ভাড়া করা বাসায় ফিরে জানতে পারি মায়ের সাড়ে চার বছরের দোয়ার কথা। আমাকে ফিরে পাওয়ার জন্যে সর্বত্র ছুটে বেড়িয়েছেন। নিজের খিদে নিবারণের খাবার অন্যর হাতে তুলে দিয়েছেন। ঘরের হাস, মোরগ, ছাগল, চাল, ডাল ইত্যাদি বিলিয়ে দিয়েছেন অসহায় মানুষের মধ্যে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেছেন, তিনি যেন আমাকে নিরাপদে রাখেন। প্রতিদিন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে চোখের পানি ফেলেছেন দুই হাত তুলে। প্রতিদিন গোসল শেষে ভেজা কাপড়েই ছুটে যেতেন সৈয়দ জাহান (রহ.) এর মাজারে। সেখানে দাঁড়িয়ে মহান রবের উদ্দেশ্যে হাত তুলতেন। চোখের পানি ফেলতেন আমাকে ফিওে পাওয়ার আশায়। মায়ের দোয়ার শক্তি ব্যর্থ হয়নি। সকল বিপদ কাটিয়ে ফিরে এসেছি মায়ের কোলে। মায়ের কারণে মহান সৃষ্টিকর্তাকে চিনেছি। ধর্মজ্ঞান অর্জন করেছি।’
সিলেট শহরতলির ইসলামপুরের জাহানপুরের মো. মাসুক মিয়া গর্ভধারিনী মায়ের ভালোবাসা ও দোয়ার শক্তি সম্পর্কে বিবরণ দেন। ২৪ আগস্ট সন্ধ্যার পরপরই মাসুক মিয়ার বাড়িতে যাওয়ার পর দেখা ভিন্ন এক চিত্র। বাড়ির আঙ্গিনায় নানান ধরণের যানবাহন পার্কিং করা। বাড়ির ভেতরে অনেক লোকের সমাগম। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো তাঁরা এসেছেন দূর দূরান্ত থেকে। বিভিন্œ সমস্যা আর রোগে আক্রান্ত। মাসুক মিয়ার সামনে গিয়ে সমস্যার কথা বলছেন। সমস্যা বা রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তির কপালে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে হাত রাখেন মাসুক মিয়া। তার পর বিদেয় করে দেন। জানিয়ে দেন মহান আল্লাহ রহম করবেন। দুপুর তিনটার দিকে গিয়ে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। ২০-২৫ জন লোক এক সাথে খেতে বসেছেন। সবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন মাসুক মিয়া। সবাইকে খাবার দেয়া শেষ করে নিজের প্লেটে খাবার নেন। খাবার শেষে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন সময় দিতে পারেননি। রাতে কথা বলবেন বলে জানিয়ে দেন। কথা মত যেতে হয় রাতে। এক সময় তিনি কিছুটা অবসর হলে মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক জানতে চাইলে, দুই চোখে পানি আসে মাসুক মিয়ার।
তিনি জানান, ‘ মা-বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান তিনি। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাকিম মৃত্যুবরণ করেছেন ২০০৩ সালে। মা রাহেলা বেগম (৭০)। ছোট দুই বোন মনোয়ারা বেগম ময়না ও আনোয়ারা বেগম পারুল স্বামী সংসারে।’
মাসুক মিয়া জানান, ‘মায়ের দোয়ার শক্তি নিয়ে ভিন্ন এক জগতে বসবাস করছি। যে জগতের মাধ্যমে মানুষের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি। কিন্তু আমার প্রতিটা মূহূর্ত কাটে মায়ের সেবা করে। ২০১২ সালে আমার মা প্রথম স্ট্রোক করেন। ওইসময় আমি মাটি কাটার শ্রমিক ছিলাম। সকাল ৯ টায় পাশর্^বর্তী এলাকায় মাটি কাটার কাজে বের হয়ে যাই। বেলা ২ টার দিকে বাড়ি ফিরি দুপুরের খাবার খেতে। বাড়ি ফিরে দেখি মা চুলার পাশে মাটিতে অচেতন হয়ে পরে আছেন। চারদিকে পাতার লাকরিতে আগুন জ¦লছে। সেসময় রান্নার জন্যে লাকড়ি হিসেবে পাতা ব্যবহার করা হতো। মায়ের অবস্থা দেখে প্রচন্ডভাবে আঘাত পেলাম মানষিকভাবে। মাকে কাঁেধ নিয়ে স্থানীয় এক ডাক্তারের চেম্বারের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে থাকলাম। ডাক্তার সাহেব আমার মায়ের দেহে স্যালাইন পুশ করলেন। স্যালাইন পুশ করতেই কোমায় চলে যান মা। ওই অবস্থায় মাকে নিয়ে গেলাম ওসমানী হাসপাতালে। ডাক্তার সাহেব পরীক্ষা করে বললেন মা আর ফিরবেন না। ওই কথা শুনে চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। মহান আল্লাহর দরবারে দোয়ার দরখাস্ত করলাম। আমার কাছ থেকে মাকে কেড়ে না নেয়ার জন্যে দুই চোখের পানি ফেলে দোয়া করতে থাকলাম। অচেতন অবস্থায় মাকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসি। তিনদিনব্যাপী মায়ের জন্যে দোয়া করতে থাকি। মহান আল্লাহর রহমতের আশায় চোখের পানি ফেলতে থাকি। মহান আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। তিনদিন পর জ্ঞান ফিরে আসে মায়ের। ওইদিন থেকে মহান রবের প্রতি গভীর বিশ^াসের জন্ম নেয়। পাক রাব্বুল আল আমিন যে, সব কিছুই করতে পারেন-তার প্রমাণ পেয়ে যাই। কয়েকদিনের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন মা। এর পর থেকে ১১ বার স্ট্রোক করেছেন মা। প্রতিবারই শুধু পরীক্ষা করিয়েছি। কোনো ডাক্তারি চিকিৎসা করাইনি। আমি নিজেই আমার ইলম্ দিয়ে মায়ের চিকিৎসা করেছি। যে ইলম্ পেয়েছি মায়ের দোয়ায়। সর্বশেষ এ বছরের (২০২৫) রমজান মাসের ১৫ দিন আগে মা স্ট্রোক করেন। এবার একটু কাহিল হয়ে পড়েছেন মা। মুখের কথা বন্ধ রয়েছে। আমি আশা করছি মহান রবের কুদরতে মা আবার কথা বলতে পারবেন। আমি অপেক্ষায় আছি মহান সৃষ্টিকর্তার রহমতের আশায়।