ট্রান্স নারী শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করল মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি

সচিত্র সিলেট
প্রকাশিত আগস্ট ১৮, ২০২৫
ট্রান্স নারী শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করল মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সিলেটের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি থেকে সম্প্রতি এক ট্রান্স নারী শিক্ষার্থীকে ‘আজীবন বহিস্কার’ বহিস্কার করা হয়েছে। সাহারা চৌধুরী নামের ওই শিক্ষার্থী ট্রান্স নারী সংগঠকও।

তাকে বহিস্কার নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও তার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের ১৬২ ব্যক্তি গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন। শনিবার এক বিবৃতিতে তারা এ দাবি জানান। পৃথক বিবৃতিতে এ বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী নারী মুক্তি, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন ও ডাইভার্স ফেমেনিস্ট। তবে ওই শিক্ষার্থীর শাস্তি দাবি করেও অনলাইনে প্রচারণা চালাচ্ছেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, অনলাইনে কিছু ব্যক্তিকে হুমকী প্রদান ও ‘ক্যাম্পাসে ‘অস্ত্রবহণ করে অন্য শিক্ষার্থীদের মনে ভয়ের সঞ্চার করায়’ তাকে বহিস্কার করা হয়েছে।
গত ১৩ আগস্ট তাকে ‘আজীবন বহিস্কার’ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওই শিক্ষার্থী মেট্রোপিলট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। যদিও ভর্তির পর ওই শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বৃত্তিও প্রদান করেছিলো।

জানা যায়, সম্প্রতি ফেসবুকে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেনকে নিয়ে ফেসবুকে ব্যঙ্গ কার্টুন শেয়ার করেন সাহারা চৌধুরী। ওই কার্টুনের মাধ্যমে হুমকি প্রদান করা হয়েছে অভিযোগ এনে ভাটেরা থানায় সাহারার বিরুদ্ধে জিডি করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ও বাইরের ‘কিছু গোষ্টি’ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সাহারাকে বহিস্কার করার দাবি জানায়। এর প্রেক্ষিতে সাহারাকে ১৩ আগস্ট বহিস্কার করে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি।

এ ব্যাপারে ওই শিক্ষার্থী বলেন, আমি উৎস ও সারোয়ারকে নিয়ে ব্যাঙ্গ কার্টুন একে ফেসবুকে শেয়ার করেছিলাম। তারা এটিকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হিসেবে আখ্যা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে জিডি করেছে। এরপর কিছু শিক্ষার্থী আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দেয়। এর কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে বহিস্কার করে। বহিস্কাদেশে কোনো কারণ দেখানো হয়নি।

এ প্রসঙ্গে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির প্রক্টর শেখ আশরাফুর রহমান বলেন, সে (সাহারা) রাষ্ট্রের কিছু সম্মানীয় মানুষকে অনলাইনে হুমকী দিয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যলয় ক্যাম্পাসে তার কর্মকান্ড অন্য শিক্ষার্থীদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছে। সে সাথে ছুরি বহন করতো। এ কারণে অন্য শিক্ষার্থীরা তার সাথে ক্লাস করতে রাজী নয়। স্টুন্ডেন্টরা ক্লাস বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিলো।

প্রক্টর আরও বলেন, ওই শিক্ষার্থী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সাফওয়ান চৌধুরী রাবিল নামে। হঠাৎ করে সে সাহারা চৌধুরী রেবিল হয়ে গেছে। তারপর থেকে সে মেয়েদের মতো পোষাক পড়তো। এগুলো তো আমাদের আইন সমাজ এলাউ করে না।

শেখ আশরাফুর রহমান বলেন, তারপরও আমরা চেয়েছি সে তার কোর্স কমপ্লিট করুক। তাই তাকে অনেকবার বুঝানো চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এতে লাভ হয়নি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।

তবে ছাত্র ইউনিয়নের সিলেট জেলা সংসদের সভাপতি মনীষা ওয়াহিদ বলেন, মেট্রোপলিটনে ভর্তির সময়ই সাহারা রূপান্তরিত নারী ছেলেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ‘ওয়ার্ম রিসিপশন’ দিয়েছিলো। এখন কিছুলোক মব সৃষ্টি করার পর তাকে অন্যায়ভাবে বহিস্কার করা হয়েছে।

সাহারার অস্ত্রবহন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রূপান্তরিত হওয়ার পর নিরাপত্তার স্বার্থেই সে ব্যাগে একটি ছুরি বহন করতো। এটি সবাইকে জানিয়েই করতো। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে অবগত ছিলো। তিনি বলেন, সে কাউকে হুমকী দিলে এটি পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বিহিনী দেখবে। বিশ্ববিদ্যালয়েথেকে বহিস্কার করবে কেন?

এ ব্যাপারে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান তৌফিক আহমদ চৌধুরীর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

১৬২ নাগরিকের বিবৃতি: ট্রান্স নারী শিক্ষার্থী সাহারা চৌধুরীর আজীবন বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও তার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের ১৬২ ব্যক্তি। শনিবার এক বিবৃতিতে তাঁরা এ দাবি জানান।

বিবৃতি স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষাবিদ আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আজফার হোসেন, আইনজীবী মানজুর আল মতিন, সাংবাদিক সায়দিয়া গুলরুখ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিউতি সবুর প্রমুখ।

বিবৃতিতে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, ১১ আগস্ট রাতে ফেসবুকে এন্টার্কটিকা চৌধুরী নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন এবং মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক (খণ্ডকালীন) আসিফ মাহতাব উৎসকে বিষয়বস্তু করে দুটি কার্টুন ক্যারিকেচার প্রকাশ করা হয়। ক্যারিকেচারগুলো প্রকাশের পর সরোয়ার ও উৎস ফেসবুক অ্যাকাউন্টটিকে সাহারা চৌধুরীর বলে দাবি করেন এবং তাঁদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে মর্মে সাহারা চৌধুরীর বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর সাহারা চৌধুরীও নিরাপত্তাহীনতা এবং হুমকির মুখে সরোয়ার, উৎসসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন।

বিশিষ্ট নাগরিকেরা বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ করছি, বিগত কয়েক বছর ধরে সরোয়ার ও উৎসের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ একটি গোষ্ঠী লাগাতার ভিন্ন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে ঘৃণা ছডড়িয়ে তাদেরকে হত্যাযোগ্য এবং অচ্ছুৎ করে তুলছেন। এই সংঘবদ্ধ বিমানবিকীকরণের ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে মজলুম এই মানুষগুলো আরও লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। শিক্ষক পরিচয়কে ব্যবহার করে সমাজে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বিভেদ ছড়ানোর মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশাকেও তাঁরা কলুষিত করেছেন।’

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ ঘটনার মাধ্যমে ভিন্ন লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে সমাজে ছড়িয়ে থাকা ঘৃণা ও বৈষম্য স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষক পরিচয় ব্যবহার করে সমাজে বিদ্বেষ এবং বিভেদ ছড়ানো হয়েছে। সাহারা চৌধুরীর বহিষ্কার শুধু একজন শিক্ষার্থীর অধিকার হরণ নয়, বরং শিক্ষাঙ্গন ও সমাজে বৈষম্যের সংস্কৃতি আরও দৃঢ় করছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জুলাই অভ্যুত্থানের পর নতুন সামাজিক সহিষ্ণুতার আশা থাকলেও একদল ঘৃণাজীবী ‘ইসলাম রক্ষা’ নাম দিয়ে এই পরিবেশকে ধ্বংসের চেষ্টা করছে। তারা ভিন্ন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের এবং তাঁদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো সবাইকে লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। এ ছাড়া অভ্যুত্থান–পরবর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কৃতি, জাতি ও লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের প্রতি যথাযথ সহমর্মিতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং কখনো কখনো তাদের পক্ষপাতদুষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে।

সাহারা চৌধুরীর বহিষ্কারাদেশ বাতিল করা, ভিন্ন লিঙ্গ ও সংখ্যালঘুর অধিকার সুরক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ নিশ্চিত এবং ভন্ডাচারের জন্য সংশ্লিষ্টদের ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা।

এ বিষয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য মারজিয়া প্রভা বলেন, ‘সাহারা চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নিয়ম ভঙ্গ করেননি, তবু সিলেট মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয় মবের (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণ) চাপের কাছে নতজানু হয়ে তাঁকে আজীবন বহিষ্কার করেছে। এতে শিক্ষার্থীর অধিকার লঙ্ঘিত হওয়া ছাড়াও ট্রান্স আইডেন্টিটির মানুষদের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়েছে।’

September 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930